Home স্বাস্থ্য খবর সুস্থ জাতি গড়তে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুষ্টি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি

সুস্থ জাতি গড়তে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুষ্টি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি

65
0
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুষ্টি

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। অর্থনীতি বেড়েছে, জীবনমানও উন্নত হচ্ছে। কিন্তু এক জায়গায় এখনো আমাদের বড় ঘাটতি – তা হলো পুষ্টি, যা একটি সুস্থ জাতি গড়তে অত্যাবশ্যকীয়। শহরে নানা সুযোগ-সুবিধা থাকলেও, গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুষ্টি এখনও শুধুই খাতা-কলমে। অথচ একটি সুস্থ, শক্তিশালী ও কর্মক্ষম জাতি গঠনের জন্য পুষ্টির বিকল্প নেই।

পুষ্টি মানেই শুধু পেট ভরানো নয়

আমরা অনেকেই ভাবি যে তিন বেলা পেট ভরে খাওয়া মানেই পুষ্ট থাকে। কিন্তু আসলে খাবারের গুণগত মানই প্রকৃত পুষ্টি নির্ধারণ করে।

একজন মানুষকে সুস্থ থাকতে হলে শুধু ভাত বা রুটি নয়, দরকার প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, আঁশ (ফাইবার) ও চর্বির সঠিক সমন্বয়।

গ্রামীণ অঞ্চলে এখনো অনেক পরিবারে দিনে একবেলা বা দুইবেলা ভাত ও আলু খাওয়াই নিয়ম। সেখানে ডাল, শাকসবজি, মাছ, দুধ, ডিম – এগুলোর নিয়মিত প্রাপ্তি নেই। ফলাফল – শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে, মায়েরা রক্তশূন্যতায় ভুগছেন, এবং কর্মক্ষমতা কমছে।

শিশুদের পুষ্টিহীনতা – সুস্থ জাতি গড়ার পথে বাধা

ইউনিসেফের সাম্প্রতিক তথ্যমতে, বাংলাদেশের ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রায় ২৮% খর্বকায় (stunted) এবং ৯% অতিমাত্রায় দুর্বল (wasted)।

এর মানে হলো, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের একটি বড় অংশ শারীরিক ও মানসিকভাবে পূর্ণ বিকাশে পৌঁছাতে পারছে না।

একজন অপুষ্ট শিশুর শুধু উচ্চতা নয়, বুদ্ধিবিকাশ, শেখার ক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা-ও কমে যায়। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুষ্টি সংকটের মূল কারণ

বাংলাদেশের প্রান্তিক অঞ্চল যেমন চরাঞ্চল, হাওর-বাঁওড়, উপকূলীয় এলাকা ও পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে পুষ্টির ঘাটতি সবচেয়ে বেশি।

মূল কারণগুলো হলো:

  1. দারিদ্র্য: নিম্ন আয়ের কারণে খাদ্যতালিকা সীমিত।
  2. খাদ্য বৈচিত্র্যের অভাব: ভাত ও আলুর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা।
  3. অজ্ঞতা ও সচেতনতার ঘাটতি: অনেকেই জানেন না কোন খাবার শরীরের জন্য কীভাবে কাজ করে।
  4. স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপদ পানির অভাব: ডায়রিয়া, সংক্রমণ ও পরজীবী রোগে পুষ্টি নষ্ট হয়।
  5. নারীদের অবহেলা: পরিবারে প্রথমে সবাই খায়, শেষে মায়েরা – ফলে তারা সবচেয়ে বেশি অপুষ্ট।

প্রান্তিক পর্যায়ে পুষ্টি নিশ্চিত করার উপায়

১. স্থানীয় খাদ্য উৎসকে কাজে লাগানো

বাংলাদেশের মাটি ও পানি এমন যে, দেশীয় ছোট মাছ, শাকসবজি, ফলমূল ও ডাল খুব সহজেই উৎপাদন করা যায়।

প্রান্তিক জনগণকে যদি এই স্থানীয় খাদ্যের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া যায়, তারা নিজেরাই নিজের পুষ্টি ঘাটতি পূরণ করতে পারবে।

গ্রামে প্রতিটি বাড়ির পাশে অল্প জমি আছে – সেই জায়গায় লাউ, পুঁই, পালং, শাক, টমেটো, কাঁচামরিচ লাগালে বছরের বেশিরভাগ সময় সবজি পাওয়া সম্ভব।

২. গৃহভিত্তিক বাগান

গ্রামে প্রতিটি বাড়ির পাশে অল্প জমি আছে – সেই জায়গায় লাউ, পুঁই, পালং, শাক, টমেটো, কাঁচামরিচ লাগালে বছরের বেশিরভাগ সময় সবজি পাওয়া সম্ভব।

এতে বাজার নির্ভরতা কমে, পুষ্টি বাড়ে এবং আয়ও হয় কিছুটা।

৩. স্কুলভিত্তিক পুষ্টি শিক্ষা ও খাবার কর্মসূচি

প্রতিটি স্কুলে যদি দুপুরের খাবার হিসেবে ডিম, ডাল, সবজি, খিচুড়ি নিয়মিত দেওয়া যায়, তাহলে শিশুদের পুষ্টিহীনতা কমবে এবং একটি সুস্থ জাতি গড়তে সহায়ক হবে।

একই সঙ্গে শিক্ষকরা যদি পুষ্টি শিক্ষা দেন, তা পরিবারের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে।

৪. নারী ও কিশোরীদের সচেতনতা বৃদ্ধি

নারীরা পরিবারের খাদ্যবন্টনের মূল সিদ্ধান্তগ্রহণকারী। তাই নারীদের পুষ্টি জ্ঞান ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করলে পুরো পরিবার উপকৃত হয়।

বিশেষ করে কিশোরীদের আয়রন, ক্যালসিয়াম, ও ফোলিক অ্যাসিডযুক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।

৫. সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা

সরকারের “পুষ্টি বর্ধন কর্মসূচি (NNP)” এবং NGO-গুলোর গ্রামীণ প্রকল্পগুলো যদি সমন্বিতভাবে কাজ করে, তাহলে প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে পুষ্টি সেবা সহজলভ্য হবে এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুষ্টি নিশ্চিত হবে।

স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পুষ্টি কাউন্সেলিং, ওজন-উচ্চতা মাপা, ও প্রয়োজনীয় সাপ্লিমেন্ট প্রদান – এসব নিশ্চিত করা দরকার।

৬. খাদ্য নিরাপত্তা ও মূল্যনিয়ন্ত্রণ

পুষ্টিকর খাবার যেমন ডিম, মাছ, ডাল ও দুধের দাম প্রান্তিকে প্রায়ই নাগালের বাইরে। সরকারের উচিত ভর্তুকি ও স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যনিয়ন্ত্রণ করা, যাতে সবাই সমানভাবে পুষ্ট খাবার পায়।

পুষ্টি বিনিয়োগ মানেই মানবসম্পদ উন্নয়ন

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি ১ ডলার পুষ্টি খাতে বিনিয়োগে ১৬ ডলার সমমূল্যের অর্থনৈতিক লাভ হয়।

কারণ, সুস্থ মানুষ মানে কর্মক্ষম মানুষ; কর্মক্ষম মানুষ মানে উৎপাদনশীল অর্থনীতি।

যখন প্রান্তিক মানুষ পুষ্ট থাকবে, তখন তারা কাজ করতে পারবে, তাদের সন্তান পড়াশোনায় মনোযোগী হবে, সমাজে দারিদ্র্য কমবে। এই পুষ্টিই হচ্ছে একটি সুস্থ জাতি গঠনের ভিত্তি।

উপসংহার

বাংলাদেশে উন্নয়নের গতি থামাতে পারে মাত্র একটি  জিনিষ, আর তা হচ্ছে মানবসম্পদের দুর্বলতা। যদি আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুষ্টি নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে সেই দুর্বলতা কখনো দূর হবে না। তাই এখন সময় “সবার জন্য পুষ্টি, প্রান্তিকের জন্য বিশেষ গুরুত্ব” – এই নীতিকে বাস্তবায়ন করার।

প্রতিটি পরিবারে, প্রতিটি স্কুলে, প্রতিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পুষ্টি সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে। একটি সুস্থ, শক্তিশালী ও জ্ঞানসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে, প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকেও পুষ্টির আলোয় আনতে হবে। তখনই গড়ে উঠবে সত্যিকার অর্থে সুস্থ জাতি ও টেকসই উন্নত বাংলাদেশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here