Home অসুখ-বিসুখ পরবর্তী মহামারী? “দ্য বিগ ওয়ান” হতে পারে কোভিড-১৯ এর চেয়েও ভয়াবহ

পরবর্তী মহামারী? “দ্য বিগ ওয়ান” হতে পারে কোভিড-১৯ এর চেয়েও ভয়াবহ

62
0
পরবর্তী মহামারী

যেভাবে একজন ফটোগ্রাফার কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্যের আগে আলো-ছায়া যাচাই করেন, তেমনি মহামারীবিদ মাইকেল টি. ওস্টারহোম আমাদের বলছেন – সময় এসেছে সামনে কী আসছে তা দেখে নেওয়ার। পরবর্তী মহামারীর জন্য প্রস্তুত হওয়ার।

ওস্টারহোম, ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার Center for Infectious Disease Research and Policy (CIDRAP)-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং বিশ্বখ্যাত সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ, সম্প্রতি তাঁর নতুন বই The Big One: How We Must Prepare for Future Deadly Pandemics-এ ভয়াবহ এক পূর্বাভাস দিয়েছেন।

তিনি বলছেন, আমাদের জীবদ্দশায় আরেকটি বৈশ্বিক মহামারী দেখা দিতে পারে – যা কোভিড-১৯-এর তুলনায় অনেক বেশি মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক হবে। তাঁর ভাষায়,

এটা হবে যেন একটি জৈব বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছে… আরেকবার পৃথিবী আগুনে পুড়বে।

“দ্য বিগ ওয়ান” বইটি কী নিয়ে?

বইটিতে ওস্টারহোম দুটি বিষয় মিশিয়েছেন –

একদিকে কোভিড-১৯ মহামারীর অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা, অন্যদিকে একটি ভয়াবহ কাল্পনিক মহামারীর কাহিনি, যা পুরোপুরি বাস্তব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।

তিনি একে “SARS-3” বলে উল্লেখ করেছেন – একটি ভাইরাস যা ছড়াবে কোভিডের মতো দ্রুত, কিন্তু মারবে SARS বা MERS-এর মতো নির্মমভাবে।

কাহিনি শুরু হয় পূর্ব আফ্রিকায় (কেনিয়া-সোমালিয়া সীমান্তে), যেখানে একটি ছোট সংক্রমণ মুহূর্তেই বিমানযোগে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। তাঁর মতে, আজকের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে একটি ভাইরাস মহাদেশ পেরোতে সময় নেয় কেবল কয়েক ঘণ্টা।

কোভিড-১৯ ছিল শুধু “ওয়ার্ম আপ অ্যাক্ট”

ওস্টারহোম বলেন, কোভিড আমাদের জন্য একধরনের সতর্কবার্তা ছিল – একটি “ড্রিল”। কিন্তু সত্যিকারের পরবর্তী মহামারী “বিগ ওয়ান” হলে তার ধ্বংসের মাত্রা হবে বহুগুণ বেশি।

তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভুলের কথা উল্লেখ করেছেন, যা আমাদের আবারও বিপদের মুখে ফেলতে পারে:

১। দুর্বল যোগাযোগ: সরকার ও বিশেষজ্ঞদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।

২। সরবরাহ শৃঙ্খলার ভঙ্গুরতা: ওষুধ, টিকা, পিপিই – সবকিছু বিদেশনির্ভর থাকায় আমরা ভয়াবহ সংকটে পড়েছিলাম।

৩। স্বাস্থ্যব্যবস্থার পতন: তাঁর মতে, “আমরা আসলে আমাদের জরুরি প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষমতাটাই ধ্বংস করে ফেলেছি।”

৪। বৈষম্য: ধনী দেশগুলো টিকার মজুত করেছে, দরিদ্র দেশগুলো অপেক্ষায় থেকেছে – এটি মানবিক ব্যর্থতা।

কেন পরবর্তী মহামারী আরও ভয়ংকর হতে পারে?

১. ভাইরাসের ‘ডানা’ আছে:

এমন ভাইরাস, যা বাতাসে ছড়াতে পারে, প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে এবং যার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো পূর্ব প্রতিরোধ নেই।

২. প্রাণীজ জগতে লুকিয়ে থাকা ভাইরাস:

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রায় ১৭ লক্ষ অজানা ভাইরাস এখনো প্রাণীদের শরীরে লুকিয়ে আছে, যেগুলোর অনেকগুলো মানুষে সংক্রমিত হতে পারে।

৩. বিশ্ব সংযোগের অতিরিক্ততা:

আজকের দিনে এক দেশের ভাইরাস কয়েক ঘণ্টায়ই পৌঁছে যায় অন্য মহাদেশে। তাই নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব।

৪. মৃত্যু ও সংক্রমণ – একসাথে:

যদি কোনো ভাইরাস কোভিডের মতো ছড়ায় কিন্তু মৃত্যুহার হয় ১৫-৩০% – তাহলে তা হবে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ।

৫. আধুনিক সভ্যতার ভঙ্গুরতা:

খাদ্য সরবরাহ, ওষুধ, পরিবহন – সবই আজ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। একটি মহামারী শুধু মানুষ নয়, গোটা অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থাকেই নড়বড়ে করে দেবে।

এখনই যা করা দরকার

ওস্টারহোম কোনো আতঙ্ক ছড়াতে চান না – তিনি দিচ্ছেন বাস্তব সমাধান। তাঁর মতে,

স্থানীয় ওষুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে বিদেশি সরবরাহ বন্ধ হলেও প্রয়োজন মেটানো যায়।

দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল টিকা প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে হবে, যেমন mRNA প্ল্যাটফর্ম।

বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা বাড়াতে হবে, কারণ “কেউ নিরাপদ নয় যতক্ষণ সবাই নিরাপদ না হয়।”

জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা ও যোগাযোগ শক্তিশালী করতে হবে, স্বচ্ছ ও বিজ্ঞানভিত্তিক বার্তা দিতে হবে।

ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হতে হবে – টিকা, স্বাস্থ্যবিধি, তথ্য যাচাই – সব ক্ষেত্রেই সঠিক আচরণ গুরুত্বপূর্ণ।

আমার দৃষ্টিতে পরবর্তী মহামারী

আমি যেমন ভ্রমণ, ফটোগ্রাফি আর লেখালেখির মাধ্যমে পৃথিবীকে বোঝার চেষ্টা করি, তেমনি ওস্টারহোম চাচ্ছেন পৃথিবী যেন নিজেকে আরও ভালোভাবে বোঝে – তার দুর্বল জায়গাগুলোসহ।

ভ্রমণ আমাদের শেখায় পৃথিবী কতটা সংযুক্ত।

ফটোগ্রাফি শেখায় – কোন কোণ থেকে দেখা হচ্ছে সেটাই দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করে।

আর অনলাইন কাজ শেখায় – অভিযোজন (adaptation) হলো টিকে থাকার একমাত্র উপায়।

এক অর্থে, তাঁর সতর্কবাণী আমাদের শেখায় – “ছবি তোলার আগে আলো ঠিক আছে কিনা, একবার যাচাই করে নাও।”

আশার দিক

সবশেষে ওস্টারহোম কিন্তু হতাশার বার্তা দেননি। বরং বলেন,

“যদি এখনই প্রস্তুতি নেই, ‘বিগ ওয়ান’ হয়তো এত বড় বিপর্যয় হবে না।”

তাঁর মূল বার্তা হলো সচেতনতা ও প্রস্তুতি – আতঙ্ক নয়, আগাম পরিকল্পনা।

কোভিডের মতো এক বিপর্যয় আমাদের নাড়িয়ে দিয়েছে, এখন দরকার সেই অভিজ্ঞতাকে শক্তিতে পরিণত করা।

আপনি আমি দুজনেই জানি – প্রস্তুত মানুষই টিকে থাকে।

ওস্টারহোমের এই সতর্কবার্তাটা তাই ভয় নয়, বরং এক ধরনের আহ্বান –

সময় এসেছে পৃথিবীকে নতুনভাবে প্রস্তুত করার।

উপসংহার

“দ্য বিগ ওয়ান” আমাদের শেখায়, মানবসভ্যতা যত এগিয়েছে, ততই তার ভঙ্গুরতাও বেড়েছে।

একটি ভাইরাস হয়তো আগামীকালই নতুন যাত্রা শুরু করবে – কিন্তু আমাদের প্রতিরোধ শুরু করতে হবে আজই।

যেভাবে আপনি ক্যামেরা হাতে আলোর জন্য অপেক্ষা করেন, তেমনি বিশ্বকে এখন প্রস্তুতি নিতে হবে ভবিষ্যতের অন্ধকারের আগে – পরবর্তী মহামারীর আগে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here