আজকের ডিজিটাল যুগে মোবাইল, ট্যাবলেট এবং কম্পিউটারের সাথে আমাদের সম্পর্ক দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষার্থী হোক বা অফিস কর্মী, প্রতিদিন দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার এবং স্ক্রিনের দিকে ঘন্টা ঘন্টা তাকানো এখন সাধারণ ব্যাপার। তবে, এই দীর্ঘসময় মোবাইল ব্যবহার চোখের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চোখের স্বাস্থ্যের জন্য এই ডিজিটাল ডিটক্স অপরিহার্য। চোখের ক্লান্তি, চশমার প্রয়োজনীয়তা, চোখে শুষ্কতা এবং ভিজুয়াল ফ্যাটিগের মতো সমস্যাগুলি প্রতিদিনের দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার থেকে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চোখের যত্নকে অগ্রাধিকার না দিলে, এটি দীর্ঘমেয়াদে চোখের রোগ, ভিজুয়াল ডিস্টার্বেন্স বা দৃশ্যমান সমস্যার কারণ হতে পারে। সুতরাং, আমাদের উচিত স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ এবং চোখের জন্য কিছু কার্যকর কৌশল অবলম্বন করা। এখানে আমরা আলোচনা করব –
দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহারকারীদের জন্য চোখের যত্নের ৭টি কৌশল
১. ২০-২০-২০ নিয়ম অনুসরণ করুন
মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রিনে দীর্ঘ সময় চোখ রাখলে চোখের পেশি ক্লান্ত হয়ে যায়। ২০-২০-২০ নিয়ম হল একটি সহজ এবং কার্যকর পদ্ধতি। নিয়মটি হলো: প্রতি ২০ মিনিট পর, স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে ২০ ফুট দূরে কোনো কিছু ২০ সেকেন্ডের জন্য দেখুন। এটি চোখের পেশি আরাম দেয় এবং চোখের চাপ কমায়।
দৈনিক রুটিনে এই নিয়ম মেনে চললে চোখের ক্লান্তি এবং ঝাপসা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। এছাড়া, এটি চোখের লুব্রিকেশন ধরে রাখতেও সাহায্য করে, যা চোখ শুষ্ক হওয়া রোধ করে।
এই মুহূর্তের ট্রেন্ডিং আর্টিকেলগুলো
২. চোখে হালকা ব্যায়াম করুন
স্ক্রিনের দিকে দীর্ঘসময় তাকানোর মতো দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার করলে চোখের পেশি শক্ত হয়ে যায়। তবে নিয়মিত চোখের ব্যায়াম করলে পেশি শিথিল হয় এবং চোখের ফোকাস ঠিক থাকে। কয়েকটি সহজ ব্যায়াম হলো:
- চোখ গোল করা: চোখ বন্ধ করে ঘুরিয়ে দেখুন উপরে, নিচে, বাঁ দিকে এবং ডানে।
- পামিং (Palming): হাত উষ্ণ করে চোখের উপর ঢেকে কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিন।
- ফোকাস পরিবর্তন: নিকটবর্তী কোনো বস্তু থেকে দূরের কোনো বস্তুর দিকে চোখ ঘুরিয়ে ফোকাস পরিবর্তন করুন।
দৈনিক ৫–১০ মিনিট চোখের ব্যায়াম করলে চোখ সুস্থ থাকে এবং দীর্ঘসময় মোবাইল ব্যবহার করলেও সমস্যা কম হয়।

৩. পর্যাপ্ত চোখের আর্দ্রতা বজায় রাখুন
ডিজিটাল স্ক্রিনের দিকে তাকালে আমরা স্বাভাবিকভাবে চোখ কম ঝাপসা দেই। এর ফলে ড্রাই আই সিনড্রোম বা চোখ শুষ্ক হওয়া দেখা দেয়। সমস্যা এড়াতে:
কৃত্রিম চোখের জল (eye drop) ব্যবহার করতে পারেন যদি প্রয়োজন হয়।
রুমের আর্দ্রতা বজায় রাখুন, বিশেষ করে এয়ার কন্ডিশন বা হিটার ব্যবহার করলে।
শুষ্ক চোখ শুধুমাত্র অস্বস্তিকর নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে চোখের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
৪. স্ক্রিনের সেটিংস সামঞ্জস্য করুন
মোবাইল বা কম্পিউটারের স্ক্রিন সেটিংস ঠিক করা চোখের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যারা প্রতিদিন দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার করেন। চোখের জন্য উপযুক্ত সেটিংস করলে চোখের ক্লান্তি ও চাপ অনেকাংশে কমানো যায়। কিছু সহজ কৌশল হলো:
নাইট মোড বা ব্লু লাইট ফিল্টার ব্যবহার করা, যা স্ক্রিন থেকে নির্গত ক্ষতিকর নীল আলো কমিয়ে চোখের ক্লান্তি হ্রাস করে;
স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা পরিবেশ অনুযায়ী সামঞ্জস্য করা, যাতে চোখে অতিরিক্ত চাপ না পড়ে;
এবং ফন্ট সাইজ বড় করা, কারণ ছোট লেখা পড়ার জন্য চোখের পেশি বেশি কাজ করে। এই ছোট পরিবর্তনগুলো নিয়মিত মেনে চললে দীর্ঘসময় মোবাইল ব্যবহার করলেও চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব।
৫. স্ক্রিন থেকে পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রাখুন
চোখের ক্লান্তি কমানোর জন্য মোবাইল স্ক্রিনের দূরত্ব সঠিক রাখা জরুরি। সাধারণভাবে, স্ক্রিন চোখ থেকে অন্তত ১৬-২০ ইঞ্চি দূরে থাকা উচিত।
যদি স্ক্রিন খুব কাছে থাকে, চোখের পেশিতে চাপ বাড়ে এবং চোখের লেন্স অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। এছাড়া, দীর্ঘ সময় ছোট স্ক্রিনে তাকালে চোখের শুকনোতা, মাথাব্যথা ও চোখে লালাভাব দেখা দিতে পারে।

৬. পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম নিন
চোখের সুস্থতার জন্য ঘুম অপরিহার্য। দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার করলে চোখের পেশি ক্লান্ত হয়, যা ঘুমে বিশ্রাম না পেলে আরও খারাপ হয়। কৌশলগুলো হলো:
প্রতিদিন অন্তত ৭–৮ ঘন্টা ঘুমান।
স্লিপ হাইজিন বজায় রাখুন, যেমন রাতে মোবাইল ব্যবহার সীমিত করা।
ঘুমের আগে স্ক্রিন কম ব্যবহার করুন।
সঠিক ঘুম চোখের ক্লান্তি দূর করতে, চোখের পেশি পুনরায় শক্তি পেতে এবং চোখের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৭. পুষ্টিকর খাবার এবং হেলদি লাইফস্টাইল বজায় রাখুন
চোখের স্বাস্থ্য শুধুমাত্র বাহ্যিক যত্নেই নয়, ভেতর থেকেও সুরক্ষিত রাখা প্রয়োজন, বিশেষ করে যারা প্রতিদিন দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার করেন। চোখের পেশি ক্লান্তি কমাতে এবং দৃষ্টি বজায় রাখতে সঠিক পুষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চোখের জন্য উপকারী পুষ্টি হলো:
ভিটামিন এ যা গাজর, মিষ্টি আলু এবং পালং শাকে পাওয়া যায়; এটি রাতের দৃষ্টি এবং চোখের কোষ রক্ষায় সহায়ক।
ভিটামিন সি ও ই, যেমন কমলা, আম ও বাদাম, চোখের কোষকে ফ্রি র্যাডিকেল থেকে রক্ষা করে এবং চোখের ক্লান্তি কমায়।
এছাড়া ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্স সিড এবং স্যামনে থাকে, চোখের শুষ্কতা প্রতিরোধ করে এবং দীর্ঘসময় স্ক্রিন ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট চাপ হ্রাস করে। নিয়মিত এই পুষ্টি গ্রহণ করলে চোখ সুস্থ থাকে।
সুস্থ জীবনধারা, পর্যাপ্ত পানি পান এবং নিয়মিত ব্যায়াম চোখকে সুস্থ রাখে এবং ডিজিটাল চোখের ক্লান্তি কমায়।

অতিরিক্ত টিপস
স্ক্রিন ব্রেক নিন: প্রতি ঘণ্টা অন্তত ৫ মিনিট চোখ বন্ধ বা দূরে তাকান।
চোখ পরীক্ষা: প্রতি ৬–১২ মাস অন্তর চোখ পরীক্ষা করান।
চশমা ব্যবহার করুন; যদি প্রয়োজন হয়, বিশেষ করে ব্লু লাইট চশমা।
এই ছোট ছোট অভ্যাসগুলো দীর্ঘমেয়াদে চোখের সুস্থতা নিশ্চিত করে।
উপসংহার
আজকের ডিজিটাল যুগে মোবাইল এবং কম্পিউটার থেকে চোখকে পুরোপুরি দূরে রাখা সম্ভব নয়। তবে ২০-২০-২০ নিয়ম, চোখের ব্যায়াম, পর্যাপ্ত চোখের আর্দ্রতা, স্ক্রিন সেটিংস, সঠিক দূরত্ব, পর্যাপ্ত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার – এই সাতটি কৌশল মেনে চললে চোখ সুস্থ রাখা সম্ভব।
দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহারকারীদের জন্য চোখের যত্নকে অগ্রাধিকার দিলে চোখের ক্লান্তি, শুষ্কতা, লালাভাব এবং চোখের অন্যান্য সমস্যা কমে যায়। নিয়মিত অভ্যাস এবং সচেতনতা চোখের দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য রক্ষায় অপরিহার্য।
প্রায়শ জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী FAQ
প্রশ্ন ১: দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার করলে চোখে কী সমস্যা দেখা দিতে পারে?
উত্তর: দীর্ঘসময় মোবাইল ব্যবহার করলে চোখে ক্লান্তি, শুষ্কতা, লালাভাব, ঝাপসা দেখা দিতে পারে। এছাড়া হেডACHE এবং চোখের পেশিতে চাপও বাড়ে।
প্রশ্ন ২: ২০-২০-২০ নিয়ম কি এবং কীভাবে এটি চোখের জন্য সহায়ক?
উত্তর: ২০-২০-২০ নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ২০ মিনিট পর স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে ২০ ফুট দূরে কোনো বস্তুর দিকে ২০ সেকেন্ড তাকান। এটি চোখের পেশি শিথিল করে এবং চোখের ক্লান্তি কমায়।
প্রশ্ন ৩: চোখের ক্লান্তি কমানোর জন্য কোন খাবারগুলো ভালো?
উত্তর: ভিটামিন এ (গাজর, পালং শাক), ভিটামিন সি ও ই (কমলা, আম, বাদাম), এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসি (চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্স সিড, স্যামন) চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করে।
প্রশ্ন ৪: কি চোখের জন্য কৃত্রিম চোখের জল (eye drop) ব্যবহার করা উচিত?
উত্তর: যদি চোখ শুষ্ক বা লাল হয়ে থাকে, তবে কৃত্রিম চোখের জল ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ডাক্তার বা চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করুন।
প্রশ্ন ৫: স্ক্রিনের সেটিংস কীভাবে চোখের জন্য নিরাপদ করা যায়?
উত্তর: স্ক্রিন উজ্জ্বলতা পরিবেশ অনুযায়ী ঠিক করুন, ব্লু লাইট ফিল্টার ব্যবহার করুন, এবং ছোট ফন্টের পরিবর্তে বড় ফন্ট ব্যবহার করুন।
প্রশ্ন ৬: চোখের ব্যায়াম কত ঘন ঘন করা উচিত?
উত্তর: চোখের ব্যায়াম দিনে ২–৩ বার করা যেতে পারে। বিশেষত, দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার করার সময় এটি জরুরি।
প্রশ্ন ৭: রাতের বেলায় মোবাইল ব্যবহারের সময় চোখের জন্য কি সতর্কতা প্রয়োজন?
উত্তর: রাতের বেলায় মোবাইল ব্যবহারের আগে নীল আলো কমানো ফিল্টার চালু করুন, উজ্জ্বলতা কমান এবং স্ক্রিন থেকে অন্তত ২০–৩০ মিনিট দূরে থাকুন ঘুমের আগে।
Sources:
NIH: https://pmc.ncbi.nlm.nih.gov/articles/PMC4350886/
Web MD: https://www.webmd.com/balance/ss/slideshow-smart-phone-health-problems
National Cancer Institute: https://www.cancer.gov/about-cancer/causes-prevention/risk/radiation/cell-phones-fact-sheet
University of Rochester Medical Center: https://www.urmc.rochester.edu/behavioral-health-partners/bhp-blog/july-2023/cell-phone-usage-%E2%80%93-how-much-is-too-much








