Home দীর্ঘায়ু এই পাঁচটি অভ্যাস আপনার আয়ু বাড়াতে পারে ১৫ বছর

এই পাঁচটি অভ্যাস আপনার আয়ু বাড়াতে পারে ১৫ বছর

72
0
আয়ু বাড়াতে

একটি বিশাল গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ৫টি অভ্যাস সনাক্ত করেছেন যা মানুষের আয়ু ১২ বছরের বেশী দীর্ঘায়িত করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি’র বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন কিভাবে একজন মানুষের খাদ্যাভ্যাস, ওজন, ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস তার স্বাস্থের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তারা জানতে চেয়েছিলেন কেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্কদের আয়ু অন্যান্য যে কোন উন্নত দেশের মানুষের আয়ুর তুলনায় বেশি। তারা গবেষণার ফলাফলে আশচর্যান্বিত হন যখন দেখেন যে শুধু একটি নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণের মাধ্যমে মানুষ তার আয়ু বাড়াতে পারে।

গবেষণার জন্য বিজ্ঞানীগণ ১২৩,২১৯ জন (৭৮,৮৬৫ নারী, ৪৪,৩৫৪ পুরুষ) মানুষের জীবনধারা প্রশোত্তর এবং মেডিকেল বিবরণ পরিমাপ করেন। গবেষণাটি ৩৪ বছর চলে। গবেষণা অনুযায়ী যারা একটি নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারা অনুসরণ করেছেন তাদের গড় আয়ু ১২ বছর (পুরুষদের ক্ষেত্রে) এবং ১৪ বছর (নারীদের ক্ষেত্রে) বেড়ে যায়।

গবেষণাটি প্রকাশিত হয় “সার্কুলেশন” (Circulation) নামক জার্নালে। গবেষকরা দেখতে পান, “একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্কদের অকাল মৃত্যু অনেকাংশেই কমাতে পারে এবং আয়ু বাড়াতে পারে।“

পুরুষ ও নারী, যারা এই জীবনধারাটি অনুসরণ করেন তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবণা ছিল অন্যানদের তুলনায় ৮২% কম, এবং ক্যান্সার রোগে মৃত্যুর সম্ভাবণা ছিল ৬৫% কম।

গবেষণাটির সহরচয়িতা এবং হার্ভার্ড টি এইচ চ্যান স্কুল অফ পাবলিক হেলথ-এর অধ্যাপক মায়ার স্ট্যামফার বলেন, “আমরা যখন গবেষণাটি শুরু করি, তখন আমি অবশ্যই জানতাম যে যারা এই অভ্যাসগুলো অনুসরণ করে তাদের আয়ু হয় বেশী। কিন্তু, আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে এর প্রভাব ছিল অনেক বিশাল”।

স্ট্যামফার আরো বলেন জনগণকে জানতে হবে যে তাদের স্বাস্থ্যহানির জন্য তাদের অস্বাস্থ্যকর জীবনধারাই দায়ী, এবং সমাজের উচিৎ একটি মানুষের স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ সহজসাধ্য করা। এবং যখন মানুষ মনে করে যে অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস ত্যাগ করার সময় পার হয়ে গেছে, তখন আমরা দেখতে পাই তাদের মধ্যে যারা অভ্যাস পরিবর্তন করেছেন তাদের জীবনে অসাধারাণ সাফল্য এসেছে।

গবেষণা অনুযায়ী সর্বোৎকৃষ্ট জীবনধারাটিতে ছিল ৫টি অভ্যাস

১। স্বাস্থ্যকর খাদ্য তালিকা

আয়ু বাড়াতে প্রথমেই আপনাকে একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য তালিকা বেছে নিতে হবে যেখানে থাকবে গোমাংস, চিনি, এবং সম্পৃক্ত চর্বির (saturated fat) পরিমাণ খুবই কম এবং শাকসব্জি, ফল-মূল এবং পূর্ণ শস্য (whole grains) বেশী। স্বাস্থ্যকর খাদ্য তালিকা বলতে এমন একটি সুষম খাবার পরিকল্পনাকে বোঝায় যেখানে গোমাংস, চিনি এবং সম্পৃক্ত চর্বির (saturated fat) পরিমাণ খুবই কম রাখা হয়। এর পরিবর্তে থাকে প্রচুর শাকসবজি, ফল-মূল, পূর্ণ শস্য (whole grains), ডাল, মাছ ও স্বাস্থ্যকর তেল। এই ধরনের খাদ্য তালিকা শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে, হৃদরোগ ও স্থূলতা প্রতিরোধ করে এবং সার্বিকভাবে শক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

২। ধূমপান নয়

এটি শুধু একটি উপদেশ নয়, বরং একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্য প্রতিজ্ঞা। ধূমপান ফুসফুস, হৃদয়, মস্তিষ্কসহ শরীরের প্রায় সব অঙ্গের ক্ষতি করে। এতে ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ ও অকাল বার্ধক্যের ঝুঁকি বাড়ে। যারা ধূমপান ত্যাগ করেন, তাদের শরীরে দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন আসে—শ্বাস নিতে সুবিধা হয়, শক্তি বাড়ে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। তাই বলুন, “ধূমপান নয়, জীবন হোক সুস্থ।”

৩। পরিমিত মদ্যপান

মদ্যপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অভ্যাস, তাই না করাই সর্বোত্তম। অ্যালকোহল লিভার, হৃদয় ও মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে আসক্তি সৃষ্টি করে। তবে কেউ যদি মদ্যপান করেই, তবে সীমিত পরিমাণে করা উচিত—পুরুষদের ক্ষেত্রে দিনে সর্বোচ্চ ৩০ গ্রাম এবং নারীদের ক্ষেত্রে দিনে সর্বোচ্চ ১৫ গ্রাম এর বেশি নয়। নিয়ন্ত্রণে রাখলে ঝুঁকি কমে, কিন্তু পরিহার করাই আসল স্বাস্থ্যরক্ষা।

৪। আয়ু বাড়াতে হালকা ব্যায়াম

প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হালকা ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। হাঁটা, দড়ি লাফ, যোগব্যায়াম, সাইকেল চালানো বা হালকা স্ট্রেচিং—সবই হালকা ব্যায়ামের অন্তর্ভুক্ত। এটি রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে, মেজাজ ভালো রাখে, ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হৃদয়কে সুস্থ রাখে। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম মানসিক চাপ কমায় ও ঘুমের মান উন্নত করে। তাই প্রতিদিনের রুটিনে ৩০ মিনিট ব্যায়াম রাখুন—শরীর ও মন দুটোই থাকবে সতেজ।

৫। বডি ম্যাস ইন্ডেক্স (BMI)

বিএমআই (Body Mass Index বা শরীরের ভর সূচক) হলো একটি পরিমাপ যা আপনার উচ্চতা ও ওজনের অনুপাত অনুযায়ী শরীরের চর্বির মাত্রা নির্ধারণ করে। এটি বোঝাতে সাহায্য করে আপনি স্বাভাবিক ওজনে আছেন কিনা। স্বাস্থ্যকর থাকার জন্য বিএমআই হওয়া উচিত ১৮.৫ থেকে ২৪.৯ এর মধ্যে। এই সীমার নিচে থাকলে তা কম ওজন নির্দেশ করে, আর বেশি হলে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা বোঝায়। সঠিক বিএমআই মানে সুস্থ শরীর ও সক্রিয় জীবন।

ইভান কন্টোপান্টেলিস, ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বলেনঃ

“গবেষণায় আমরা যা জানতে পারলামঃ আপনি যদি ধূমপান করেন, তাহ’লে এখনই তা বন্ধ করুন! এটাই হচ্ছে সর্বৎকৃষ্ট সিদ্ধান্ত যা আপনি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য করতে পারেন। ব্যায়াম করতে চেষ্টা করুন, বেশী পরিমাণে মদ্যপান করবেন না এবং একটি সুষম খাদ্য তালিকা অনুসরণ করুন। এবং এই তিনটি জীবনধারার পরিবর্তন আপনার বডি ম্যাস ইন্ডেক্স (body mass index BMI) একটি স্বাভাবিক পরিসরের মধ্যে রাখবে, কারণ ব্যায়াম ক্ষুধা কমাতে পারে এবং মদে আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি।“

লেস মেহিউ, লন্ডনের ক্যাস বিজনেস স্কুলের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক নিউজউইক সাময়িকীকে এক সাক্ষাৎকারে বলেনঃ

“গবেষণার ফলাফল খুবই অর্থবহ এবং এটা সুস্বাস্থ্যের উপর সারা বিশ্বে সম্পাদিত গবেষণাগুলিকে সমর্থন করে।“

যদি সবাই কম ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্য আচরণ অনুসরণ করত, তাহলে সমাজে অনেক কম অসমতা থাকত। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে বেশী ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্য আচরণ অর্থনৈতিক অসমতার সঙ্গে যুক্ত, এবং এটা আয়ু বাড়াতে একটি বাধা।

যুক্তরাজ্যের ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটি মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপিকা সারা স্টুয়ার্ট ব্রাউন বলেন যে গবেষণার ফলাফলে জনগণ আশ্চর্য হবেন না, তবে তারা খুবই অশ্চর্য্য হবেন পাঁচটি কারণে মানুষের আয়ু কতখানি দীর্ঘায়িত হবে তা জেনে। তিনি তর্ক করেন এবং নিউজউইক সাময়িকীকে বলেনঃ

“কিন্তু, মানুষ কি কারণে অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা বেছে নেয় সে ব্যপারে গবেষণায় কিছু বলা হয়নি। একটি ক্ষেত্রে দেখা যায় এই জীবনধারা মানুষের নিজস্ব পছন্দের, আবার অন্য ক্ষেত্রে দেখা যায়, যা আমরা সবাই জানি, মানুষ প্রচুর ধূমপান, মদ্যপান এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্য ভক্ষণ করে যখন তারা খুবই বিষন্ন থাকে”।

“আমরা বেশীরভাগ মানুষই যখন আমরা খুব বিষন্ন বোধ করি তখন এই তালিকার মধ্যে একটি বা দুইটি অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করি। প্রতিনিয়ত সব পাঁচটির দরকার হলে বুঝতে হবে সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য খুবই খারাপ। খারাপ মানসিক স্বাস্থ্য মানে হচ্ছে মানুষ এই ধরনের নির্ভরতা অন্যদের তুলনায় বেশী চায়। কিন্তু, খারাপ মানসিক স্বাস্থ্য অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা ছাড়াই স্বাস্থ্যহানি ঘটাতে পারে, কারণ মানসিক চাপ শরীরের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ ব্যহত করতে পারে”।

উপসংহার

গবেষণাটি স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে যে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা কেবল রোগ প্রতিরোধই নয়, আয়ু বাড়াতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। সুষম খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকা, প্রতিদিনের হালকা ব্যায়াম এবং সঠিক বিএমআই বজায় রাখা – এই পাঁচটি অভ্যাস একসাথে গড়ে তোলে দীর্ঘ, সুস্থ ও সক্রিয় জীবন। ছোট ছোট পরিবর্তনও বড় প্রভাব ফেলতে পারে – যেমন একটু বেশি হাঁটা, একটু কম চিনি খাওয়া, আর নিজের শরীরের যত্ন নেওয়া। মনে রাখুন, সুস্থ জীবনই হলো দীর্ঘ জীবন।

 

Sources:

Harvard Health [https://www.health.harvard.edu/staying-healthy/longevity-lifestyle-strategies-for-living-a-healthy-long-life]

Time [https://time.com/7326301/4-science-habits-longer-life/]

Johns Hopkins Medicine [https://www.hopkinsmedicine.org/health/wellness-and-prevention/4-top-ways-to-live-longer]

WebMD [https://www.webmd.com/healthy-aging/ss/slideshow-longer-life-secrets]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here